★★★ ধবলগিরি ★★★

ANUPAM DEY



                       লাশের স্তূপ থেকে এক আহত সৈনিক তার ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে বের হয়ে এসেছেন । জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তার প্রচণ্ড তৃষ্ণাবোধ হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দয়া নদীর দিকে কোনক্রমে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একটু গলা ভেজাতে না পারলে এ যাত্রা তিনি আর প্রাণে বাঁচবেন না এই তার আশঙ্কা !
নদীর কাছাকাছি এসে ভয়ে শিউরে উঠলেন তিনি। অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, “জল কোথায় ?”
বিশাল দয়া নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া কল্পনাতেও অসম্ভব ! তাহলে কি দেখে ভয় পেয়েছিলেন সেই সৈনিক ? নদীর জল ঠিকই বয়ে চলেছিল আপন স্রোতে । কিন্তু সেদিন দয়া নদীর জল ঠিক আমাদের পরিচিত জলের মতো ছিল না। সেই জলের রঙ ছিল টকটকে লাল !
-----------এসব কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতার এক অতি ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র ।

দয়া নদী
                               পিতা বিন্দুসারের মৃত্যুর পর ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয় মৌর্য্য সম্রাট হিসাবে সম্রাট অশোক মগধের সিংহাসন লাভ করেন । অশোক প্রথম জীবনে একজন বদমেজাজী ও ক্রূর প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন । তার এই স্বভাবের জন্য তাঁকে "চণ্ডাশোক" নামে অভিহিত করা হত।
                               সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন । এই সময়ের মধ্যে উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর করায়ত্ত হলেও কলিঙ্গ কখনোই তার বশ্যতা স্বীকার করেনি । তার পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তার পিতা সম্রাট বিন্দুসার কলিঙ্গ জয় করার চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু দুজনেই কলিঙ্গের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন । 
                              কলিঙ্গ জয় করতে পারলে দাক্ষিনাত্যের অভিযান পরিচালনা করা অনেক সহজ হবে -এই কথা মাথায় রেখে সম্রাট অশোক নতুন করে কলিঙ্গ জয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন ও তার রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করে দেন ।
                          কলিঙ্গের রাজা অনন্ত পদ্মানাভানের বাহিনীতে ছিল প্রায় ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী এবং ৭০০ হাতি অপরপক্ষে সম্রাট অশোকের বাহিনীতে প্রায় ৬ লাখ পদাতিক, ৩০ হাজার অশ্বারোহী, ৯ হাজার হাতি এবং ৮ হাজার যুদ্ধরথ বিদ্যমান ছিল ।
                          অশোকের সুসজ্জিত বিশাল বাহিনীর সাথে কলিঙ্গ বাহিনীর প্রথম সাক্ষাত হয় ধৌলি পাহাড় সংলগ্ন ময়দানে। সেখানে দুই বাহিনী তাদের সকল শক্তি নিয়ে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তার যুদ্ধকৌশলের কাছে কলিঙ্গের সৈনিকরা প্রথম থেকেই পেরে উঠছিল না ।কিন্তু কলিঙ্গের শক্তিশালী বাহিনী এত সহজে পরাজয় স্বীকার করতে নারাজ। তারা বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে ঘুরে দাঁড়াতে থাকেন। যুদ্ধে দুপক্ষেরই ব্যাপক রক্তক্ষয় শুরু হয় । কলিঙ্গের সাধারন জনগণ ছিল অত্যন্ত স্বাধীনচেতা । সৈন্যদের সাথে সাথে ক্রমশ তারাও যুদ্ধে যোগ দেন ।
যুদ্ধের তীব্রতা দেখতে দেখতে একসময় পুরো কলিঙ্গ রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে । তাদের প্রতিটি সক্ষম পুরুষ এই যুদ্ধে যোগদান করে । যুদ্ধের ময়দানে ক্রমেই লাশের পর লাশের স্তূপ গড়ে ওঠে। কলিঙ্গের আকাশে তখন শকুনের আনাগোনা । যুদ্ধক্ষেত্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দয়া নদীর জল রক্তের মিশেলে টকটকে লাল হয়ে যায় ।
                        অপরাজেয় অশোক শেষপর্যন্ত বিজয়ী হলেন । কলিঙ্গের প্রতিটি সৈনিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন । প্রায় এক বছরব্যাপী চলা এই যুদ্ধে কলিঙ্গের লক্ষাধিক মানুষ নিহত হন , অশোকের বাহিনীর প্রচুর সেনাও প্রাণ হারান। জানা যায়, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কলিঙ্গে শ্রম খাটানোর মত কোনো জীবিত দাস খুঁজে পাওয়া যায়নি।ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতের ইতিহাসে এর চেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর কখনো হয়নি।
                       ময়দানের যুদ্ধতো শেষ হল, কিন্তু অশোকের মনে শুরু গল অন্য এক যুদ্ধ । যুদ্ধক্ষেত্রের নিদারুন হত্যা লীলা ও কলিঙ্গ বাসীর হাহাকার, আর্তনাদ ও দুদর্শা অশোকের মনে গভীর অনুশোচনার উদ্রেক করে ।কথিত আছে, যুদ্ধের পর এক কলিঙ্গ বৃদ্ধা অশোকের দরবারে হাজির হন। কলিঙ্গে যুদ্ধে বৃদ্ধার স্বামী, পিতা এবং সন্তান প্রাণ হারান। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সম্রাটকে প্রশ্ন করেন, “আপনার কারণে আমি সব হারিয়েছি। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচবো?”
                         অনুতাপ হতে চিত্তের প্রশান্তির জন্য তিনি সাম্রাজ্যবাদের নীতি পরিত্যাগ করে অহিংস নীতির অনুসারী হন এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন । সমগ্র বিশ্বে তিনি হয়ে উঠেন মৈত্রী ও অহিংসার মূর্ত প্রতীক । "চন্ডাশোক" পরিনত হন "ধর্মাশোক"-এ ।
ভূবনেশ্বর থেকে পুরি যাবার রাস্তায় ৮ কিমি বাদে দয়া নদীর ব্রীজ পার হয়ে ডানদিকের ছোট রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই এই ধৌলি পাহাড় । যা এখন আমাদের কাছে ধবলগিরি নামেই অধিক পরিচিত ।




ধবলগিরি বৌদ্ধস্তুপের বৌদ্ধমূর্তি

                                  পাহাড়ের একাবারে শীর্ষদেশে জাপানের কোন এক বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সংস্থার পক্ষ থেকে বর্তমানে একটি শ্বেতশুভ্র বৌদ্ধ স্তুপ নির্মিত হয়েছে । স্তুপের ভেতর চারটি বৌদ্ধমূর্তি ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গীতে চতুর্মুখী অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় । পাহাড়ের গা বেয়ে একেবারে উপরিভাগ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে উঠে যাবার মত রাস্তার ব্যাবস্থাও আছে । রাস্তার খাঁড়াই যেখান থেকে শুরু হয় তার কিছুটা আগেই ক্ষয়প্রাপ্ত এক পাহাড়ের গায়ে একটি হস্তি মূর্তির নিচে খোদিত আছে সম্রাট অশোকের সেই বিখ্যাত শীলালিপি । জলবায়ুর প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে একটি কাঁচের ঘরে এটিকে সংরক্ষিত করে রেখেছে Archeological Survey of India . ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক জেমস প্রিন্সেপ এই লিপির পাঠোদ্ধার করেন। পাশেই কয়েকটি বোর্ডে এই লিপির সারমর্ম ইংরাজি ও আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করে প্রদর্শিত আছে। উপরের বৌদ্ধস্তুপটি নির্মানের সময় ধৌলি পাহাড়ের পাদদেশেও আরো কয়েকটি বৌদ্ধমূর্তি ও একটি অশোকস্থম্ভ খচিত মিনার নির্মিত হয়েছে ।

 এই ঘরটিতে অশোকের শিলালিপি সংরক্ষিত আছে

 অশোকের শিলালিপি সংরক্ষিত স্থল

অশোকের শিলালিপি
                               এখানে আরো একটি আকষর্ণীয় বিষয় আছে । তা হল লাইট-লেজার শো । কোনার্ক ফেরতা পথে সকালের দিকে ধবলগিরি ঘুরতে এসে বৌদ্ধ স্তুপটির সামনের দিকে দুটি খুঁটির ওপর রাখা লোহার বাক্স দেখে কৌতুহল হলে এই লেসার-শো এর ব্যাপারে জানতে পারি ।
                                 প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জাপানি প্রযুক্তিতে লেজার আলো ও শব্দের সহায়তায় বৌদ্ধস্তুপটিকে পর্দার ন্যায় ব্যাবহার করে তার গায়ে সম্রাট অশোকের জীবনি, সিংহাসন লাভ, ঐতিহাসিক কলিঙ্গ যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ, কলিঙ্গবাসীর আত্মবলিদান ও যুদ্ধ পরবর্তীকালে অশোকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের নানা কাহিনী খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয় । শুরুর দু একটি দৃশ্য ছাড়া ক্যামেরা ব্যাবহারে বিধিনিষেধ আছে । অনবদ্য এই অনুষ্ঠানটি ৪৫ মিনিট ধরে চলে । টিকিট সম্ভবত মাথাপিছু ১৫০ টাকা । শো আারম্ভ হবার এক ঘন্টা আগে টিকিট বিক্রি শুরু হয় ।


লেসার এর আলোয় উদ্ভাসিত ধবলগিরি বৌদ্ধস্তুপ

                              ব্যাক্তিগত গাড়ির ব্যাবস্থা না থাকলে এই শো উপভোগ করা মুশকিল । কারন এটা শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যায় আর এতরাতে এখান থেকে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যাবস্থা নেই । নিজের বাইকে যাবার সুবাদে ও কাছাকাছি ভূবনেশ্বরের হোটেলে থাকায় আমাদের এই শো উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল । সারাদিনে উদয়গিরি, খন্ডগিরি ও লিঙ্গরাজ মন্দির ঘুরে বিকালের দিকে আবার এখানে চলে আসি । এমনিতেই এটাই ছিল আমার দেখা প্রথম লেসার-শো সেই সাথে কালজয়ী ঐতিহাসিক কাহিনীর সঙ্গতে ঐ মুহূর্তে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম । 


উদয়গিরি র গুহাচিত্রে কলিঙ্গ যুদ্ধ

 অশোক স্থম্ভ খচিত মিনার

অশোকের শিলালিপি র ইংরেজি অনুবাদ
                              বাংলা থেকে বাসে "চলুন বেরিয়ে আসি পুরী++ " বা ভ্রমণ সংস্থাগুলো ধবলগিরি র জন্য সাধারণত খুব সামান্য ও নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখে। তাই এত সুন্দর একটি অনুষ্ঠানের কথা বেশিরভাগ ভ্রমণার্থীদের কাছে অজানা ও অদেখাই রয়ে যায় ৷
শুধুমাত্র ধবলগিরি-র জন্য ট্যুর-প্লান করা অর্থহীন হলেও আগে থেকে সঠিক পরিকল্পনা থাকলে জগন্নাথদেবের দর্শনের সাথে সাথে অসাধারন এই লেসার-শো উপভোগ করে কিছুক্ষনের জন্য ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবার সুযোগ নেওয়া যেতেই পারে ।

ধৌলি পাহাড়ে র নিচ থেকে ধবলগিরি বৌদ্ধ স্তুপ

Writer & Photography :- ANUPAM DEY
                                                                          
                                                                        বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের
 Facebook Group "Cholun Berie Asi ( Let's Go & Enjoy Nature )"  join করুন 




3 comments:

  1. আসাধারন বর্ননা। ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।

    ReplyDelete
  2. আসাধারন বর্ননা। ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।

    ReplyDelete
  3. তথ্যপূর্ন, অসাধারণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.